কুমিল্লার মুরাদনগরে গণপিটুনিতে মা ও দুই সন্তানকে হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল আগের রাতে। এ নিয়ে একাধিক বৈঠকও হয়েছিল। এর মাস্টারমাইন্ড কড়ইবাড়ী গ্রামের বাছির মিয়া। তাকে খুঁজছে পুলিশ। তার সঙ্গে আরও যারা ওইসব বৈঠকে অংশ নিয়েছিল তাদের খোঁজেও কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদিকে বৃহস্পতিবারের ওই পাশবিক হত্যাকাণ্ডের পর থেকে কড়ইবাড়ী গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। গ্রেফতার আতঙ্কে তারা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। তবে এ ঘটনায় শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মামলা হয়নি। পুলিশও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
জানা গেছে, স্থানীয় স্কুলশিক্ষক রুহুল আমিনের একটি মোবাইল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেদিনের গণপিটুনির ঘটনার সূত্রপাত হয়। উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার কড়ইবাড়ী গ্রামের মাদক ব্যবসায়ী রোকসানা বেগম রুবির মেয়ের জামাই মনির হোসেনের সহযোগী মারুফ ওই শিক্ষকের মোবাইলটি চুরি করে। এ ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে মারুফকে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে রুবি ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল ও ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়াকে মারধর করে এবং পরনের জামা ছিঁড়ে তাদের হেনস্তা করে।
এদিকে মাদক ব্যবসা, মিথ্যা মামলায় হয়রানি এবং নানা অপকর্ম নিয়ে রুবির পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘ দুই দশক ধরে বিরোধ চলছিল এলাকাবাসীর। তাই ওই ঘটনার পর রুবিবিরোধীরা সোচ্চার হয়ে ওঠে। বুধবার রাতে গ্রামে একাধিক বৈঠক হয়। মূলত গ্রামের বাছির মিয়াসহ কয়েকজন মিলে এসব বৈঠক ডাকেন। সেখানে মাদক কারবারি ওই পরিবারের সবাইকে গণপিটুনিতে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
এতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই গ্রামের বাসিন্দারা রুবির বাড়ির আশপাশে অবস্থান নেয়। দফায় দফায় হাতাহাতি করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা হয়। এসবের নেপথ্যে কাজ করে বাছির মিয়া গং। পরে কয়েকশ মানুষ একসঙ্গে পরিবারটির ওপর হামলা করে। এ সময় বাড়ির শিশুদের সরিয়ে দেওয়া হয়। গণপিটুনিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন-রুবি, তার মেয়ে জোনাকি ও ছেলে রাসেল। গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান রুবির অপর মেয়ে রুমা আক্তার।
নিহত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার বলেন, মোবাইল ফোন চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পরিকল্পিতভাবে আমার স্বামী-শাশুড়ি এবং ননদকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার আগের রাতে বাছির মিয়ার নেতৃত্বে কয়েকবার বৈঠক করা হয়। এর আগে বুধবার বাছির আমার স্বামীকে কল দিয়ে বলেছিল, ‘তোর পুরো পরিবারকে শেষ করে দেব।’ তখন আমার স্বামী বলেছিল, পারলে তুই কিছু করিস। কিন্তু আমি স্বপ্নেও ভাবিনি, এমন ঘটনা ঘটবে।
মীম আরও বলেন, আগের দিন বুধবার বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতির পর আমার স্বামী আমার বাবার বাড়িতে ছিলেন। সকালে ঝামেলার কথা শুনে তিনি মোটরসাইকেল নিয়ে কড়ইবাড়ী আসেন। বাড়ির কাছে আসতেই তার ওপর হামলা চালানো হয়। ইট দিয়ে থ্যাঁতলে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়। আমার স্বামী বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে মারিস না, আমার ছোট্ট একটা বাচ্চা আছে।’ মীম দাবি করেন, এ ঘটনায় চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল ও বাচ্চু মেম্বারসহ কয়েকজন মাতব্বরের ইন্ধন রয়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘর পুরুষশূন্য। বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এলাকায় ঘোরাফেরা করছে। গ্রেফতার আতঙ্কে গ্রামের লোকজন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ঘটনার পর থেকে ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল, ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া, শিক্ষক রুহুল আমিনসহ কয়েকজন মাতব্বরও আত্মগোপনে চলে গেছেন।
এলাকাবাসীর দাবি, রুবির পরিবার দুই দশকের বেশি সময় ধরে মাদক কারবারে জড়িত। মাদকের টাকায় তারা ব্যাপক সম্পদ গড়েছেন। পুলিশ বেশ কয়েকবার তাকে গ্রেফতার করলেও জামিনে বের হয়ে আবার মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। তার স্বামী, সন্তান এবং মেয়ের জামাইও মাদক কারবারে জড়িত। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এজন্য এলাকার মানুষ তাদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করায় রুবি এলাকার লোকজনের বিরুদ্ধে ৮২টি মামলা করেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, রুবির ছয়তলা বিশাল বাড়ি। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে তিনতলা ও একতলা আরও দুটি ভবন রয়েছে। পাশেই একটি দোতলা মার্কেট। সবই তাদের। কড়ইবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, রুবি মাদক কারবারি। তার কারণে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। কিন্তু এভাবে তাদের হত্যা করা হবে, সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা পুরো ঘটনা তদন্ত করে দেখার দাবি জানাচ্ছি।
পুলিশ বলছে, সেদিনের ঘটনার নেপথ্যে যারা ছিল তাদের অবস্থান ও গতিবিধি লক্ষ্য করা হচ্ছে। ঘটনার দিন মাইকে কারা ঘোষণা দিয়েছে তাদেরও খোঁজা হচ্ছে। বিপুলসংখ্যক জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করার নেপথ্যে কারা কাজ করেছে তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাছাড়া চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এসেছে। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে কার কী ভূমিকা তা দেখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাঙ্গরা বাজার থানার ওসি মাহফুজুর রহমান বলেন, আমরা বেশ কিছু মোটিভ নিয়ে কাজ করছি। ঘটনার মাস্টারমাইন্ড ও ইন্ধনদাতাদের খোঁজ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, শুক্রবার বিকালে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।