গত ৩০ জানুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বল্পোন্নত দেশের
কাতার থেকে চূড়ান্তভাবে বের হওয়ার পদক্ষেপ হিসেবে রফতানিমুখী ৪৩টি খাতে নগদ প্রণোদনা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানায়। এতে
বলা হয়, দেশের
রফতানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার
চলতি ২০২৩-২৪
অর্থবছরে ৪৩টি
খাতে রফতানির বিপরীতে রফতানি প্রণোদনা বা
নগদ সহায়তা দিয়েছে। ডব্লিউটিওর বিধিবিধান অনুসারে বিষয়টি
রফতানিনির্ভর সাবসিডি (সাবসিডি কন্টিনজেন্ট আপন এক্সপোর্ট পারফরমেন্স) হিসেবে বিবেচিত হয়
এবং এগ্রিমেন্ট অন
সাবসিডিস অ্যান্ড কাউন্টারভেইলিং মেজার্স (এএসসিএম) অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ
থেকে উত্তরণ হলে
কোনোরূপ রফতানি
প্রণোদনা বা
নগদ সহায়তা দেয়া
যাবে না।
২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে
বাংলাদেশের উত্তরণ
ঘটতে যাচ্ছে উল্লেখ
করে সার্কুলারে বলা
হয়, উত্তরণ পরবর্তী সময়ে রফতানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা
সম্পূর্ণভাবে একত্রে
প্রত্যাহার করা
হলে রফতানি খাত
চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। তাই
১ জানুয়ারি থেকে
বিভিন্ন খাতে
নগদ সহায়তার হার
অল্প অল্প করে
কমিয়ে আনার বিষয়ে
সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সিদ্ধান্ত অনুসারে ১ জানুয়ারি থেকে
৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে জাহাজিকরণ করা
পণ্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ৪৩টি খাতে রফতানি
প্রণোদনা বা
নগদ সহায়তার জন্য
নতুন প্রণোদনার হার
নির্ধারণ করেছে
বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী
খোকন। ছবি: সময়
সংবাদ
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হুট করে নেয়া
এ সিদ্ধান্ত মানতে
নারাজ শিল্প মালিকরা। এ বিষয়ে আক্ষেপ
প্রকাশ করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস
অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী
খোকন বলেন,
এ সিদ্ধান্ত নেয়ার
সময় কোনো স্টেকহোল্ডারকে ডাকা হয়নি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছেন তিনি
কিছু জানেন না।
কেউ এ বিষয়ে
জানে না। কেন
এই ধরনের সার্কুলার হঠাৎ করে দেয়া
হলো? এর সিদ্ধান্তের পেছনে কারা?
এ
সিদ্ধান্তের পেছনে
কাদের স্বার্থ রক্ষা
করা হয়েছে - এমন
প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম
বলেন, এটিকে কি
পরোক্ষভাবে অন্য
কোনো দেশের বাজারে
পরিণত করতে ইচ্ছে
করে করা হয়েছে।
তৈরি
পোশাক রফতানিকারকদের শীর্ষ
সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক
প্রস্তুতকারক ও
রফতানিকারক সমিতির
(বিজিএমইএ) বিশ্লেষণ বলছে, নতুন বিজ্ঞপ্তিতে তৈরি পোশাক শিল্পের প্রধান ৫টি পণ্যে
(টি-শার্ট, সোয়েটার, নিটেড শার্ট, পুরুষদের আন্ডার গার্মেন্ট এবং
ওভেন ট্রাউজার ও
জ্যাকেট) দেয়া
নগদ সহায়তা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে
নেয়া হয়েছে। অথচ
গত অর্থবছর এ
খাতের মোট রফতানি
আয়ের ৫৫.৫২
শতাংশই এসেছিল এ
৫ পণ্যের কাঁধে
ভর করে। ২০২২-২৩
অর্থবছরে তৈরি
পোশাক শিল্পের প্রধান
৫ পণ্যের রফতানি
আয় ছিল ২৫.৯৫
বিলিয়ন ডলার।
একইভাবে রফতানি
প্রণোদনার বাইরে
ঠেলে দেয়া হয়েছে
নতুন বাজার খ্যাত
জাপান, ভারত, আর
অস্ট্রেলিয়াকে। গত
অর্থবছরে পোশাক
খাতের মোট রফতানি
আয়ের প্রায় ৮
শতাংশ বা ৩.৭৭
বিলিয়ন ডলার এ
তিন দেশ থেকেই
এসেছিল। কমানোর
নামে পোশাক খাতে
বিদ্যমান প্রণোদনার প্রায় ৭০ ভাগই
তুলে নেয়া হয়েছে।
এর আগে গত
২৪ আগস্ট দেয়া
বিজ্ঞপ্তিতে প্রণোদনা আগামী ৩০ জুন
পর্যন্ত বহাল
রাখার ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সেভাবেই ক্রয়াদেশ নিয়ে উৎপাদন ও
রফতানি প্রক্রিয়া চালু
রেখেছেন উদ্যোক্তারা। মাঝপথে এভাবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকে শিল্প
ধ্বংসের চক্রান্ত হিসেবে দেখছেন উদ্যোক্তারা।
প্রণোদনা কমানোর
বিষয়ে বিটিএমএ সভাপতি
মোহাম্মদ আলী
খোকন বলেন, ‘ওরা বলছে, প্রণোদনার এক শতাংশ কমে
গেছে। এখানে এক
শতাংশ না, আমাদের
তৈরি পোশাক শিল্পে
পুরোপুরিভাবেই প্রণোদনা বন্ধ করে ফেলা
হয়েছে।’
তৈরি পোশাক খাতের
৭০ থেকে ৮০
শতাংশ প্রণোদনার বাইরে
চলে গেছে বলে
মন্তব্য করেছেন
বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
প্রণোদনা কমানোর
সিদ্ধান্তে চামড়া
শিল্পে বিপর্যয়ের শঙ্কা।
ছবি: সময় সংবাদ
আবার চামড়া শিল্পের ঘাড়েও পড়েছে বড়
চাপ। ক্রাস্ট লেদারের রফতানি ভর্তুকি ১০
শতাংশ থেকে করা
হয়েছে শূন্য আর
ফিনিশড লেদারের প্রণোদনা কমিয়ে আনা হয়েছে
৭ শতাংশে।
চামড়া খাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করে বিটিএ
সভাপতি শাহীন আহমেদ
বলেন, বাংলাদেশ থেকে
৭০ শতাংশ ক্রাস্ট লেদার রফতানি করা
হয়। এখনও আমরা
সেভাবে পণ্য বহুমুখীকরণে যেতে পারিনি বিধায়
আমার মনে হচ্ছে
এভাবে প্রণোদনা বন্ধ
করে দিলে তা
খাতের জন্য একটি
বিপর্যয় বয়ে
আনবে।
চাপ পড়েছে রফতানি
বাজারে সম্ভাবনার আলো
ছড়ানো পাট-প্লাস্টিকসহ সব খাতেই। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পথে
রফতানিতে দেয়া
বিশেষ সুবিধা প্রত্যাহারের বিষয়ে শিল্প মালিকরাও এক মত। তবে
তা সহনশীল উপায়ে
করার দাবি তাদের।
বিটিএমএ সভাপতি
মোহাম্মদ আলী
খোকন বলেন,
আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এই দেশে
শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ
হয়ে যাবে যদি
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই বিজ্ঞপ্তি প্রয়োগ
হয়। কাজেই এখনও
সময় রয়েছে। ব্যবসায়ীদের স্বার্থে এ
সিদ্ধান্তকে প্রত্যাহার করা হোক। আমাদের
সঙ্গে বসে তারপর
এমন কিছু ধীরে
ধীরে করা হোক।
আমি বলছি না
আমাদের সারাজীবন প্রণোদনা দিতে হবে।
বাস্তবতা আমলে
নিয়ে রফতানিকারকদের যতটা
সম্ভব ছাড় দেয়ার
পরামর্শ অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবিরের। তিনি বলেন, যারা
পণ্য রফতানির সঙ্গে
জড়িত তাদের সঙ্গে
কোনো ধরনের আলোচনা
না করেই প্রণোদনা প্রত্যাহার করার
সিদ্ধান্ত নেয়া
হয়েছে। হঠাৎ করেই
ব্যবসায়ীদের কোনো
ধরনের সময় না
দিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়াকে আমি মনে
করি যে, দেশের
অর্থনীতিতে খুব
একটা ভালো ফল
নিয়ে আসবে না।
সরকার হয় তো
এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তবে এক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।