অনলাইন সংস্করণ

এ সম্পর্কিত আরও খবর

ডিজিটাল প্রশিক্ষণের নামে অর্থপাচার: খোদ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে হরিলুট

যুব উন্নয়নের নামে হরিলুট চলছে খোদ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে। সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের ঘনিষ্ঠ যুব কাউন্সিলের সভাপতি মাসুদ আলম বাগিয়েছেন প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ফ্রিল্যান্সার প্রশিক্ষণ প্রকল্প। আওয়ামী লীগের উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং তার প্রতিষ্ঠান ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেডের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তদন্ত চলছে। একটি প্রভাবশালী মহল মাসুদকে কাজ পাইয়ে দিতে সর্বোচ্চ অনিয়ম করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ২৯৭ কোটি টাকার ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রকল্পের দরপত্র সাজানো হয়েছিল নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মাসুদ আলমের ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেডের জন্য। তার বিরুদ্ধে রয়েছে অর্থ পাচার, ভুয়া সনদপত্র এবং ডিজিটাল প্রতারণার একাধিক অভিযোগ। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ‘জুলাই চেতনা’র সরকারের আমলেও সেই মাসুদের প্রতিষ্ঠানই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়।অথচ ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানিকে ১০ বছরের প্রশিক্ষণ অভিজ্ঞতার শর্তে নির্বাচিত করা হয়—যা টেন্ডার শর্তাবলির সরাসরি লজ্জাজনক লঙ্ঘন।

প্রকল্প পরিচালক আব্দুল হামিদ খান এবং কার্যাদেশপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ‘ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেড’-এর কর্ণধার মাসুদ আলমের ঘনিষ্ঠতা এবং তাদের একযোগে বিদেশ সফরের তথ্য নিয়ে ইতোমধ্যেই নানান মহলে গুঞ্জন চলছে। এই সম্পর্ক স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) তৈরি করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেডের সঙ্গে একটি প্রভাবশালী আমলাতান্ত্রিক চক্রের সম্পৃক্ততা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় রয়েছেন সাবেক যুব ও ক্রীড়া সচিব মেসবাহ উদ্দিন। সচিব থাকাকালে ২০২২ সালে তিনি ৪৬.৭ কোটি টাকার একটি প্রশিক্ষণ প্রকল্পের নকশা করেন এবং ২০২৩ সালে তার ঘনিষ্ঠ মাসুদ আলমের প্রতিষ্ঠান সেই কাজ পায়। কয়েক মাসের মধ্যেই অবসর নিয়ে তিনি নিজেই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও শেয়ারহোল্ডার হন।

মাসুদ আলমের আরেক ব্যবসায়িক অংশীদার সাবেক সচিব আখতার হোসেনের স্ত্রী মাহবুবা আজার, যিনি মাসুদের অন্য কোম্পানি নগদহাট বাংলাদেশ লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডার। কোম্পানি দুটি গঠিত হয় যথাক্রমে ২০২০ ও ২০২১ সালে। মাহবুবা ছাড়াও নগদহাটে যুক্ত ছিলেন সাবেক সচিব মো. নাসির উদ্দিন।

আখতার হোসেন ২০২২ সালে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এসডিজি সমন্বয়ক হন। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করলে প্রকল্পটি প্রাপ্তির পেছনে ক্ষমতাধর আওয়ামীপন্থী আমলাদের যোগসাজশ স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।

ক্রয় কমিটিতে উপস্থাপিত তথ্যে দেখা যায়, দরপত্রে ২০টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। গ্রহণযোগ্য হয় ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেড, বাংলাদেশ আইটি ইনস্টিটিউট, এসইও এক্সপেইট বাংলাদেশ লিমিটেড এবং নিউ হরাইজনস সিএলসি অব বাংলাদেশ। কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নে শীর্ষে উঠে আসে ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেড।

প্রতিমন্ত্রী রাসেলের ঘনিষ্ঠ মাসুদ আলমের প্রতিষ্ঠানকে প্রশিক্ষণ প্রকল্প দেওয়ায় গত অক্টোবরেই তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যদিও প্রকল্পটি সাময়িকভাবে অনিশ্চিত ছিল, পরে অজানা এক ক্ষমতার বলয়ে তা মাসুদের প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চূড়ান্ত হয়।

মাসুদ আলম ছিলেন ঢাকা মহানগর (উত্তর) ছাত্রলীগ (রবিউল-রানা) কমিটির সহসম্পাদক। তিনি ছিলেন গোসাইরহাট উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য নাহিদ রাজ্জাকের কর্মী। জাতীয় নির্বাচনে ‘শেখ হাসিনাতেই আস্থা’ নামের সোশ্যাল মিডিয়া পেজ পরিচালনা করতেন, যা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই পরিচালিত হতো।

তিনি পেয়েছেন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’, ‘শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২২’ ও জাতীয় যুব পুরস্কারসহ একাধিক সম্মাননা। তার বাবা আজাহার উদ্দিন ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা এবং ভাই রাসেল আলম ছাত্রলীগ করতেন। এক সাক্ষাৎকারে মাসুদ বলেন, “২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই। আমার বাবা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, ফলে আমি প্রাইমারি স্কুলও শেষ করতে পারিনি।”

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা এবং দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত চলায় এই কার্যাদেশ বাতিল করে নতুন করে টেন্ডার ডাকা উচিত।” তিনি আরও বলেন, “এ প্রকল্প আদৌ দেশের জন্য কতটা প্রয়োজনীয়, সেটিও যাচাই করা দরকার।”

প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার আউটসোর্সিং ও আইটি প্রশিক্ষণের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। নতুন বাংলাদেশের নামে ফ্যাসিস্ট শাসনের পুনর্ব্যবহার হচ্ছে। জনগণের অর্থের এমন অপচয় উদ্বেগজনক ও দুঃখজনক।” এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাসুদ আলমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।